সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নির্দেশনা
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পদের নিয়োগ পরীক্ষা সামনে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫ হাজার সহকারী শিক্ষক পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ১৩ লাখ ৯ হাজার ৪৬১ জন। পরীক্ষার পদ্ধতি, বিগত পরীক্ষার প্রশ্ন বিশ্লেষণ ও শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে জানাচ্ছেন রবিউল আলম লুইপা
পরীক্ষার পদ্ধতি ও মানবণ্টন : নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষার মানবণ্টন ও সিলেবাস সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তবে বিগত দুই বছরের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার (২০১৮ ও ২০১৯) প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথমে ৮০ নম্বরের এমসিকিউ ধরনের লিখিত পরীক্ষা (বাংলা ২০, ইংরেজি ২০, গণিত ২০, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার ২০) ও পরবর্তী সময়ে ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এমসিকিউ পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্নের মান ১, আর একেকটি ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর করে কমে। উপজেলার শূন্য পদ, প্রাধিকার কোটা ও নারী-পুরুষের তারতম্যের কারণে এমসিকিউ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে নম্বরের পার্থক্য দেওয়া যায়।
তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬০-৭০ নম্বর এবং নারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৫০-৬০ নম্বর পেলে মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


পরীক্ষার প্রস্তুতি :
.
১. এর আগে দেখা গেছে, বিগত সময়ের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন থেকেই অনেক প্রশ্ন কমন পড়েছে। তাই যেকোনো প্রকাশনীর জব সলিউশন বই থেকে বেশি বেশি বিগত প্রশ্নপত্রগুলো অনুশীলন করুন। এগুলো থেকেও প্রশ্ন কমন পড়তে পারে!
.
২. বাংলা :
বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলা ব্যাকরণ অংশে বানান ও বাক্য শুদ্ধিকরণ, এককথায় প্রকাশ, বাগধারা, সমার্থক শব্দ, সমাস, ধ্বনি ও বর্ণ, কারক ও বিভক্তি, উপসর্গ প্রভৃতি অধ্যায় থেকে প্রতিবছর দু-একটা প্রশ্ন আসেই। পাশাপাশি সন্ধি, পদ প্রকরণ, বিরামচিহ্ন, বিভিন্ন ধরনের বাক্য অধ্যায়গুলোও দেখে যেতে হবে। বাংলা সাহিত্য অংশের বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক, উক্তির রচয়িতা, কবি-সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম, বিভিন্ন গ্রন্থের চরিত্র প্রভৃতি থেকে নিয়মিত প্রশ্ন করা হয়। তবে বাংলা ২০ নম্বরের মধ্যে সাহিত্য থেকে ২-৩ নম্বরের প্রশ্ন থাকে, তাই ব্যাকরণ অংশে বেশি জোর দিতে হবে।
.
৩. ইংরেজি :
বিগত বছরের প্রশ্নের ইংরেজি ব্যাকরণ অংশে Vocabulary, Spelling, Preposition, Translation, Sentence correction, Subject verb agreement প্রভৃতি অধ্যায় থেকে প্রতিবছর ২-৩টা করে প্রশ্ন আসে। পাশাপাশি Parts of speech, Phrase and Idioms, Number, Voice, Narration অধ্যায়গুলোও অনুশীলন করতে হবে। ইংরেজি সাহিত্য থেকে প্রশ্ন তেমন থাকে না। বিগত বছরের কোনো কোনো প্রশ্নে ইংরেজি সাহিত্যের গ্রন্থের লেখকের নাম ও বিখ্যাত সাহিত্যিকের জীবন ও কর্ম থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে।
.
৪. গণিত :
গণিত অংশে ভালো নম্বর তোলার জন্য পাটিগণিত অংশের সংখ্যার ধারণা, লাভ-ক্ষতি, সুদকষা, অনুপাত-সমানুপাত, সময় ও দূরত্ব; বীজগণিত অংশের মান নির্ণয়, সরল সমীকরণ, বীজগণিতীয় রাশিমালা, উৎপাদকে বিশ্লেষণ এবং জ্যামিতি অংশের ত্রিভুজ ও কোণ অধ্যায়গুলো গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করতে হবে। গণিত বিষয়ে ভালো নম্বর তোলার জন্য প্রতিদিন গণিতচর্চার কোনো বিকল্প নেই।
.
৫. সাধারণ জ্ঞান :
সাধারণ জ্ঞান অংশে বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, সাধারণ বিজ্ঞান, ভূগোল ও কম্পিউটার এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। বাংলাদেশ বিষয়াবলির জন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাচীন শাসনামল, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু থেকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়। আর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির জন্য বিভিন্ন সংস্থা ও এর সদর দপ্তর, আন্তর্জাতিক দিবস, বিশ্বের বিখ্যাত স্থান প্রভৃতি; সাধারণ বিজ্ঞানের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র, রোগব্যাধি, মানবদেহ প্রভৃতি; ভূগোলের জন্য সৌরজগৎ ও সময় নির্ণয়; কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তির জন্য কম্পিউটার সংগঠন, ইনপুট-আউটপুট ডিভাইস, ইন্টারনেট অধ্যায়গুলো থেকে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। তবে সাধারণ জ্ঞানে বাংলাদেশ বিষয়াবলি থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন থাকে।
.
৬. সময় বণ্টন :
যেকোনো পরীক্ষায় ভালো করার একটি কৌশল হচ্ছে আগে থেকেই সময় বণ্টন করে নেওয়া। এখানে এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত সময় ৮০ মিনিট। অর্থাৎ প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১ মিনিট, যা অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার তুলনায় একটু বেশিই এবং সিদ্ধান্তের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে। তবে না জানা প্রশ্নে বেশি সময় নষ্ট না করে পরবর্তী প্রশ্নে চলে যেতে হবে। সব শেষে না দাগানো প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ০.২৫ করে নেগেটিভ নম্বর থাকায় কনফিউজড প্রশ্নগুলোও উত্তর করতে পারেন। কারণ পাঁচটি কনফিউজিং প্রশ্নের উত্তর করে চারটি ভুল উত্তর দিলেও আপনার কোনো নম্বর কমছে না (১ নম্বর যোগ ও ১ নম্বর বিয়োগ হবে)।
.
৭. মডেল টেস্ট :
ভালো প্রস্তুতির জন্য মডেল টেস্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার প্রস্তুতি যেমনই হোক, পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগে সময় ধরে ধরে নিয়মিত মডেল টেস্ট দিলে আপনার সুনির্দিষ্ট দুর্বলতা, সময় বণ্টন ও নেগেটিভ মার্কিং সম্পর্কে নিজেই মূল্যায়ন করতে পারবেন।
.


মৌখিক পরীক্ষা :
এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মধ্যে একাডেমিক ফলের ওপর একটা নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ থাকে। আগের নিয়োগগুলোর মৌখিক পরীক্ষা সাধারণত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, শিক্ষা বিভাগসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সমন্বয়ে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড গঠন করা হয়। এখানে নিজ জেলা, সাধারণ জ্ঞান, সাম্প্রতিক ঘটনা, শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়াবলি, স্নাতকে পঠিত বিষয়, এমনকি গান, কবিতা, প্রেজেন্টেশন স্কিলও যাচাই করা হতে পারে।
.
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ১৩তম গ্রেডে (জাতীয় বেতন স্কেল) যোগদান করেন। বেসিক বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিত্সা ভাতা, টিফিন ভাতাসহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান সহকারী শিক্ষক পদধারীরা। একজন নবনিযুক্ত সহকারী শিক্ষককে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) ১৮ মাস বা কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত নির্দিষ্ট মেয়াদি বেসিক প্রশিক্ষণ কোর্স, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। চাকরিতে যোগদানের পর সহকারী শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি ট্যাগ অফিসার, বিভিন্ন ধরনের জরিপ (যেমন—শিশু জরিপ), ভোটার তালিকা, আদমশুমারিসহ কর্তৃপক্ষ নির্দেশিত বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি (২০২০) অনুসারে নির্বাচিত প্রার্থীদের উপজেলাভিত্তিক শূন্যপদের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-২০১৯’ অনুসারে নিজ উপজেলায় পদায়ন করা হবে। কর্মস্থলভেদে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ থেকে ১২ জন সহকারী শিক্ষক কর্মরত থাকেন। তবে সাপোর্টিং স্টাফ স্বল্পতায় কাজের চাপ কিছুটা বেশি হতে পারে
.


বেসিক টপিকগুলো পড়তে হবে:
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পরীক্ষার এমসিকিউ প্রস্তুতির জন্য একেবারে বেসিক টপিকগুলো পড়তে হবে। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বই, স্কুল-কলেজে পঠিত ইংরেজি গ্রামার ও গণিত এবং সচরাচর সাধারণ জ্ঞানগুলো থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলে সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে সাধারণত প্রশ্ন করা হয় না। আমার মৌখিক পরীক্ষায় সংবিধান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আমার অনার্সে পঠিত বিষয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান, গান ও কবিতা সম্পর্কে দক্ষতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়েছিল। ভাইভা বোর্ডে অনেক সময় হাতের লেখাও যাচাই করে দেখা হয়। ’
—তানজিয়া পিয়াস, সহকারী শিক্ষক, (২০১৪ ব্যাচ), শ্রীপুর, মাগুরা।


বিগত প্রশ্নগুলোও গুরুত্বপূর্ণ
‘একজন প্রার্থীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন থেকে ধারণা নিয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি নিতে হবে। বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রশ্ন থেকেও অনেক প্রশ্ন কমন পাওয়া যাতে পারে। এখানে স্কুল পর্যায়ের পাঠ্য বইয়ের বেসিক থেকেই বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে প্রশ্ন করা হয়। মৌখিক পরীক্ষায় প্রার্থীভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে আমার গ্রামের নাম (পুঠিয়া), অনার্সে পঠিত বিষয় (হিসাববিজ্ঞান) ও নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ’
—মো. শরিফুল হক, সহকারী শিক্ষক (২০১৮ ব্যাচ), পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
//
সৌজন্য : কালের কণ্ঠ
Leave a Reply